০১ মে ২০২০ শুক্রবার, ০৫:৪২ পিএম
সময় নারায়ণগঞ্জ
তুষার আহমেদ : করোনাভাইরাসের কারণে পাল্টে গেছে মে দিবসের দৃশ্যপট। ইতিহাসের পাতায় এক নিষ্প্রাণ মে দিবস যোগ হলো আজ। দিনটিতে নারায়ণগঞ্জের রাজপথে ছিলো না শ্রমিকদের হাক-ঢাক। মাথায় লাল কাপড় ও লাল ঝান্ডা হাতে মে দিবসের চিরচেনা বিদ্রোহী রূপে দেখা মেলেনি কোন শ্রমিকদের। ছিলো না মিটিং মিছিল ও জনসভা। বৃষ্টি বিঘিœত এই স্যাঁত স্যাঁতে দিনটি অতিবাহিত হলো নিরবে, নিস্তব্ধে।
দীর্ঘদিন ধরেই করোনার প্রকোপ চলছে নারায়ণগঞ্জে। সংক্রোমণ এড়াতে লকডাউনের আওতায় রয়েছে এই জেলাটি। এতে করে স্বাভাবিক জীবন পক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটেছে নারায়ণগঞ্জবাসীর। প্রতিটি খাতই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। একই সাথে করোনা নামক এই মহামারি বাধ সেঁধেছে নারায়ণগঞ্জ’বাসীর শিল্প-সংস্কৃতিতেও।
শ্রমিক অধ্যুষিত এই জেলায় বিগত বছর গুলোতে দেখা যায়, পহেলা মে অর্থাৎ শ্রমিক দিবসে সকল শ্রেণি-পেশার শ্রমজীবীদের মিলন মেলা ঘটতো নারায়ণগঞ্জের রাজপথে। রাজনৈতিক থেকে শুরু করে সামাজিক সংগঠন গুলোকেও রাজপথে একাত্মা প্রকাশ করতে দেখা যেত। সকাল হতেই দলে দলে মিছিল নিয়ে জড়ো হতো শহরের চাষাড়া শহীদ মিনারে।
বিশেষ করে ফতুল্লার আলীগঞ্জ, পাগলা, নয়ামাটি, কুতুবপুর, পঞ্চবটি, বিসিক, পুলিশ লাইনস্ আফাজনগর, গাবতলা, ইসদাইর, মাসদাইর, ভূইগড় ও সাইনবোর্ডসহ সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজি এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে অগনিত ট্রাক যোগে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে আনন্দচিত্তে শহরে এসে জড়ো হতো হাজারো শ্রমিক। শ্রমিকদের হাতে শোভা পেতো নানা প্রতিবাদী প্লেকার্ড, লাল ঝান্ডা, ও মাথায় লাল কাপড়। শ্রমজীবী মানুষের পদচারনায় প্রকম্পিত হতো শহর থেকে শহরতলী। ঘাম ঝড়ানো পারিশ্রমিকের সঠিক মূল্যায়নের আহবান থাকতো শ্রমিকদের কণ্ঠে।
এতে বিভিন্ন কর্মপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের অংশ গ্রহণ চোখে পড়লেও গার্মেন্ট, নীটিং, ডাইং ও অন্যান্য পোশাক শিল্প শ্রমিকদের সমাগম হতো সবচেয়ে বেশি। একই সাথে শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক ও আত্মমর্যাদার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠতো বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। বিশেষ করে কানে ভেসে আসতো বাংলাদেশ শ্রমিকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রমিক উন্নয়ণ ও কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আলহাজ¦ কাউসার আহমেদ পলাশের বজ্রকণ্ঠ। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রভাবে এবছর তা কেবল ইতিহাস হয়েই রইল। এর ছিটে ফোটাও ঘটেনি কাল।
এদিকে, স্ব-শরীরে কার্যক্রম পালন সম্ভব না হলেও নিজ নিজ অবস্থান থেকে শ্রমিকদের শুভেচ্ছা জানিয়ে দিবসটির সাথে একাত্মা প্রকাশ করেছেন নেতৃবৃন্দরা। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও শ্রমিক সংগঠন সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে মহান মে দিবস পালনের জন্য বিবৃতি দিয়েছে।
এদিকে জেলা প্রশাসন ও শ্রম-কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করলেও এবার করোনার কারণে কোনো কর্মসূচিই বাস্তবায়িত হয়নি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি প্রতিবারই এই দিনটিতে শ্রমিক সমাবেশের আয়োজন করলেও এবার তা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে দিবসটি উপলক্ষ্যে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রও প্যারাডাইজ কেবলসের হাতে গোনা কয়েকজন শ্রমিক ও নেতৃবৃন্দ স্বল্প পরিসরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। শুক্রবার পহেলা মে সকালে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব চত্তরে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। কিছু সময় ফটো সেশনের পর কার্যক্রম শেষ করেন তারা।
শ্রমিক নেতা কাউসার আহমেদ পলাশ বলেন- করোনার কারণে কোন কর্মসূচি বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারী ভাবেও আমাদের জেলা প্রশাসক মহোদয় ও পুলিশ সুপার মহোদয়ের অংশগ্রহণে র্যালী এবং সমাবেশ হওয়ার কথা ছিলো। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে তা হয়নি। তবে কষ্ট হচ্ছে এই কারণেই যে, এই শ্রমিক দিবসেও আমাদের নারায়ণগঞ্জের ফকির গার্মেন্টস ও টাইম সোয়েটারের কিছু শ্রমিক আজ (গতকাল) আমার সামনে এসেছে চাকুরিচ্চুৎ হয়ে। তাদেরকে বিনা কারণে বিনা নোটিশে ছাটাই করা হলো। এর মধ্যে এমন কিছু শ্রমিক রয়েছে, যারা ১২-১৪ বছর ধরে চাকুরী করে আসছিলো।’
তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন- ‘সরকারের পক্ষ থেকে পোশাক কারখানার মালিকদের প্রনোদনা দেয়া হলেও তারা শর্তভঙ্গ করে অন্যায় ভাবে শ্রমিক ছাটাই করছেন। শ্রমিকরা তাদের কষ্টার্জিত পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’
শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়ে কাউসার আহমেদ পলাশ বলেন- একেক প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা একেকটি সংগঠন করে। তাই শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্য নেই। এই জন্যই তারা নির্যাতিত। অধিকার আদায় করতে হলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। সব শ্রমিক যদি এক ফেডারেশনের ছায়াতলে চলে আসে, তাহলে শ্রমিকরা ঐক্যবলে তাদের অধিকার আদায় করতে সক্ষম হবে।’
প্রসঙ্গত, ১৮৮৬ সালের পহেলা মে শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজের অধিকারের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্প এলাকায় ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন। আন্দোলন চলাকালে শিকাগোর হে মার্কেটের সামনে বিশাল শ্রমিক জমায়েতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ১১ শ্রমিক। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র ছাড়িয়ে ওই শ্রমিক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে গোটাবিশ্বে। গড়ে ওঠে শ্রমিক-জনতার বৃহত্তর ঐক্য। তীব্র আন্দোলনের মুখে শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। অধিকার আদায়ে শ্রমিকদের আত্মত্যাগের স্মরণে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে দিনটিকে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের সব দেশেই দিবসটি পালিত হচ্ছে। কিন্তু আজও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে ১২ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন শ্রমিকরা। হয়তো করে যাবেন চিরকাল !
সময় নারায়নগঞ্জ.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।